[এই নিবন্ধ আমি ২০১৭ সালে ডেইলি স্টারের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন স্টার উইকেন্ডের জন্য লিখেছিলাম ‘আনন্দবাজার’স অল্ট-জার্নালিজম’ শিরোনামে। সম্প্রতি, আনন্দবাজার পত্রিকা বাংলাদেশ ইস্যুতে নতুন এক বিতর্কে জড়িয়ে নিঃশর্ত ক্ষমা চায়। এই প্রেক্ষাপটে আমার এই নিবন্ধ অনেকে শেয়ার করছেন। ভাবলাম বাংলা অনুবাদ হলে আরও অনেক মানুষ পড়ার সুযোগ পাবে। মূল সংস্করণ হুবহু রাখা হয়েছে, তবে প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য তৃতীয় বন্ধনীতে যোগ করা হয়েছে। মূল সংস্করণের তুলনায় হালকা পরিমার্জিত।]
গত বছর ঢাকায় প্রিন্ট মিডিয়া ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়ে এক সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার মূল কোম্পানি এবিপি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী ডিডি পুরকায়স্থ। ডিজিটাল যুগে আনন্দবাজারের পাঠক ধরার কৌশল নিয়ে তিনি মন্তব্য করেন, “পাঠক যা চান, আমরা তা-ই দিচ্ছি।”
শতাব্দি-প্রাচীন পত্রিকা আনন্দবাজারকে এবিপি গ্রুপের মিডিয়া সাম্রাজ্যের ‘মুকুটের রত্ন’ বলা চলে। বৃটিশ শাসনের সময় থেকেই এই পত্রিকা প্রভাবশালী ছিল। পরবর্তীতেও ক্ষমতার খেলায় পত্রিকাটির সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। তবে বস্তুনিষ্ঠতা রক্ষা করে চলার সুনাম আনন্দবাজারের ছিল না বললেই চলে।
প্রিন্ট মিডিয়া জগতে যখন ডিজিটাল যুগের হাতছানি, তখন আনন্দবাজার পাঠক তুষ্ট করার অনলাইন কৌশল হাতে নিল। ঠিক যেমনটা পুরকায়স্থ বলছিলেন। কিন্তু বিনিময়ে বিকিয়ে দিলো সাংবাদিকীয় নীতি-নিষ্ঠার যা বাকি ছিল, সেটুকুও।
ওয়েব জগতে উপস্থিতি বাড়াতে গিয়ে পত্রিকাটি বাংলাদেশি পাঠক ধরার কৌশল নিয়েছে। নরম ও পছন্দনীয় ইস্যু, যেমন ক্রিকেট আর বিনোদন নিয়ে ক্রমেই বেশি বেশি লেখা আসতে থাকলো। এছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে চিরায়ত বিস্ফোরক সব মন্তব্য ও নিবন্ধ তো ছিলই।
আনন্দবাজারের এই মতামতধর্মী এজেন্ডা-নির্ভর সাংবাদিকতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হবে। কিন্তু আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হলো, বাংলাদেশকে জড়িয়ে সংবেদনশীল ইস্যুতে যেসব লেখা ছাপানো হয়, সেখানে একেবারে সাধারণ তথ্য, ইতিহাস ও সঠিকতার ধার ধারে না পত্রিকাটি।
আসুন, একেবারে সাম্প্রতিককালে আনন্দবাজারের সবচেয়ে অদ্ভুত সব কেলেঙ্কারিগুলোর দিকে একটু তাকাই। বাংলাদেশি নাম, স্থানের হাস্যকর ভুল বানান আর অসংখ্য সেনসেশনাল শিরোনামের কথা না হয় বাদই দিলাম।
‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন’
বাংলাদেশে সফররত ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধান অরূপ রাহার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আনন্দবাজার। সেখানে বর্ণনা করা হয় যে, তারা দু’ জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার একটি ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন। ঘটনাটি হলো, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতীয় বিমান বাহিনী ব্যাপক বিমান হামলা করছিল। আর গোপন আশ্রয়ে থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার মেয়ে শেখ হাসিনা সহ পরিবারের সকল সদস্য নাকি সেই হামলা প্রত্যক্ষ করছিলেন।

অথচ, বাংলাদেশ ইতিহাস নিয়ে একেবারে সামান্য জানাশোনা আছে এমন মানুষও জানবেন যে, যুদ্ধ শুরুর প্রাক্বালেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। শেখ হাসিনা সহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কব্জায় ছিলেন। ফলে ‘গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকা’র প্রশ্নই উঠতে পারে না।
এ নিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাস্যরসের সৃষ্টি হলে পত্রিকাটি ওই প্রতিবেদনের এই স্মৃতি রোমন্থনের অংশটুকু সরিয়ে নেয়। প্রতিবেদনের নিচে অস্পষ্ট একটি সংশোধনী অবশ্য ছিল।
তবে এই সংশোধনীটুকুও বেশিরভাগ সময় দেওয়া হয় না।
মুছে ফেলা সব প্রতিবেদন…
হঠাৎ করে একবার আনন্দবাজার প্রকাশ করলো কানাডার কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার অন্যতম আসামী নুর চৌধুরীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় বাংলাদেশে। পরে জানা যায় ডয়েচে ভেলে সহ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যম এই তথ্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলে গোটা প্রতিবেদনই সরিয়ে নেয় আনন্দবাজার।

আরেকটি প্রতিবেদনের বেলায়ও এমনটা হয়েছে। পত্রিকাটি লিখলো যে, বাংলাদেশি অভিনেত্রী জয়া আহসানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ফতোয়া জারি করা হয়েছে। তাকে ‘বাংলাদেশের সানি লিওন’ আখ্যা দিয়ে দেশ ছাড়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। খুনের হুমকিও নাকি দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ অসত্য এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সেটি মুছে ফেলা হয়।
বাংলাদেশের আরও দুই অভিনেত্রী পরিমনি ও আশনা হাবিব ভাবনাও আনন্দবাজারের প্রতিবেদন নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। পরিমনি বলেন পত্রিকাটি তার মন্তুব্যকে অহেতুক রং দিয়ে সেনশেশনালাইজ করেছে।
ভাবনা অভিযোগ করেন যে, তিনি যেই মন্তব্য করেনইনি, সেটিই তার সাক্ষাৎকার বলে ছাপিয়েছে আনন্দবাজার। তিনি পত্রিকাটির কোনো সাংবাদিকের সঙ্গেই কথা বলেননি বলে জানান।
‘প্রথম হিন্দু প্রেসিডেন্ট’
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বাংলাদেশের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আনন্দবাজার। এই প্রতিবেদনে একাধিক উল্লেখযোগ্য ভুল ছিল। সেখানে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট।’ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছিলেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রতিষ্ঠাকালীন প্রেসিডেন্ট। আর সুরেন্দ্র কুমার সিনহা এখন পর্যন্ত তার পদেই আছেন।

সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রধান বিচারপতির পদ প্রেসিডেন্টের পরেই। [ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকারের পর প্রধান বিচারপতির অবস্থান।] আরও বলা হয়, মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর নাকি বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ছিলেন! [এই নামে বাংলাদেশের কোনো সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন না। মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুর নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে চট্টগ্রামের জিওসি ছিলেন। জিয়া হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করে তাকেও হত্যা করা হয়।]
সেখানে আরও বলা হয়, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে তুষ্ট করতেই সিনহাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। [প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি; যদিও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে। আর সংখ্যালঘুদের তুষ্ট করতে সিনহাকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি অনুমানযোগ্য বিষয় হলেও, প্রতিবেদনে অনেকটা ‘ফ্যাক্ট’ হিসেবেই এটি উল্লেখ করা হয়!]।
এই প্রতিবেদনও সমালোচনার মুখে সরিয়ে ফেলা হয়। [আর্কাইভ রাখা প্রতিবেদনটি পড়ুন এখান থেকে।]
‘ফিজের জন্য ধোনির ব্যাট’
২০১৫ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের হয়ে অভিষেক হয় মুস্তাফিজুর রহমানের। তার বিধ্বংসী পারফরম্যান্সে সফররত ভারতীয় ক্রিকেট দল ‘বাংলাওয়াশে’র মুখে পড়ে। তখন আনন্দবাজার গল্পের মতো করে এক প্রতিবেদন করে যে, বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক মাশরাফি মোর্তুজা নাকি খেলাশেষে মুস্তাফিজকে নিয়ে যান ভারতীয় দলের অধিনায়ক এমএস ধোনির কাছে। তাকে অনুরোধ করেন যেন মুস্তাফিজকে আইপিএল-এ খেলার সুযোগ দেওয়া হয়। এমনকি মুস্তাফিজকে অনুপ্রাণিত করতে ধোনির ব্যাটও চান মাশরাফি। কেন বিজয়ী দলের অধিনায়ক বিজিত দলের অধিনায়কের কাছে ‘অনুপ্রেরণা’ খুঁজতে যাবেন, তা নিয়ে খটকা লাগে অনেকের। এরপর মাশরাফি নিজেই প্রকাশ্যে পুরো ঘটনাই উড়িয়ে দেন। কিন্তু আনন্দবাজার তাদের প্রতিবেদন সংশোধন করেনি।
‘সন্ত্রাসের আতুরঘর’
গত বছরের জুলাইয়ে ঢাকায় গুলশান হামলার পর আনন্দবাজার রীতিমত ঢাকার বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মানহানিমূলক প্রচারে নামে। সরাসরি শিরোনাম করে যে ‘এনএসইউ জঙ্গিদের আতুরঘর!’
চার মাস পর ওই প্রতিবেদকের আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেটির শিরোনাম: ‘সন্ত্রাসের আঁতুরঘর বলে চিহ্নিত ঢাকার দেড় ডজন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’। দাবি করা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট সহ ১৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সন্ত্রাসের আতুরঘর হিসেবে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ সরকার। বুয়েটের ক্ষেত্রে নাকি অজ্ঞাত ‘তদন্তে জানা গেছে’ যে, খ্যাতনামা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়টির ‘৭২ শতাংশ শিক্ষকই জামাত বা হিযবত তাহরীরের সদস্য’। তাদের কাজই নাকি হলো ‘ওয়েবসাইট, ভিডিও ফুটেজ, জেহাদি বই, অডিও সিডি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা’। এই ধরণের ভাষ্য কী করে একটি সংবাদ প্রতিবেদনের হতে পারে!
আরও সাম্প্রতিক সময়ে পত্রিকাটি নিহত এক নারী ব্যাংকারের ছবিকে চট্টগ্রামের সিতাকুণ্ডে পুলিশের গুলিতে নিহত জঙ্গির বলে প্রচার করে! এই ভুল ঠিক করতে কয়েকদিন লেগে যায় পত্রিকাটির।
আরও…
এই নিবন্ধগুলোতে নির্দিষ্ট অসত্য তথ্য ছিল বলে সেগুলোর সত্যতা নিরূপণ করা গেছে বা চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এমন অসংখ্যা প্রতিবেদন আছে যেগুলোতে অবিশ্বাস্য সব তথ্য দেওয়া হয়েছে একেবারে খুঁটিনাটি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বিশ্বাস করা দুষ্কর। এসব প্রতিবেদন যাচাইযোগ্য নয় বলে এখানে উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু দেখেই বোঝা যায় অলস মস্তিষ্কের ফসল।
আনন্দবাজারের নিজদের এক সাংবাদিকই এমন এক অদ্ভুত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সুরবেক বিশ্বাস নামে পত্রিকাটির সাংবাদিক এক নিবন্ধে অনেকটা যেন স্বীকারই করে নিয়েছেন যে বিস্ফোরক প্রতিবেদন ছাপার লোভ সংবরণ করতে তারা ব্যর্থ। যদিও ভিন্ন প্রেক্ষাপটে লেখা, তবে উদ্ধৃতিটা দিলাম এখানে:
‘যে খবরে যত মুচমুচে ‘গল্প’ থাকে, তার দর তত বেশি। সেগুলোর জন্য ‘অফিশিয়াল ব্রিফিং’ বা অফিসারদের একাংশের ‘আনঅফিশিয়াল গল্পগাছা’-র বাইরে সাংবাদিকের নিজের তদন্ত করার সুযোগ ও সময় কতটুকু? জঙ্গির খবর পুলিশ ইচ্ছাকৃত ভাবে ‘খাওয়াচ্ছে’ না অনিচ্ছাকৃত ভাবে ভুল করছে, তা যত ক্ষণ না যাচাই করতে পারছি, তত ক্ষণ খবর ফাইল করব না— এই অবস্থান সাংবাদিকের পক্ষে নেওয়া সম্ভব? উপরওয়ালার ভর্ৎসনা পর্যন্ত যাওয়ার দরকার নেই, অন্য চ্যানেল বা কাগজ বড় করে ছাপলে বা দেখালেই তো আত্মগ্লানিতে ভুগতে হয়, ইস, এ সব গল্প তো আমার কাছেও ছিল, পেয়েও ছেড়ে দিলাম!’
এরা সবাই সত্যিই ‘জঙ্গি’ তো? | সুরবেক বিশ্বাস, আনন্দবাজার, ১৫ মার্চ, ২০১৭
তিনি কি আমাদের সন্দেহেরই একটা স্বীকৃতি দিলেন যে আনন্দবাজার অনেক খবর ছাপে ভালোভাবে যাচাইবাছাই ছাড়া? হয়তো।
আনন্দবাজারের অতীত ‘কীর্তি’
লেখক আহমদ ছফা ছিলেন আনন্দবাজারের ঘোরতর সমালোচকদের একজন। উপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটে। ইলিয়াসের যেই বিখ্যাত বই আনন্দবাজারের ‘আনন্দ পুরষ্কার’ পেয়েছে, সেখানেই তিনি এই পত্রিকাকে বলেছেন বাঙালির শত্রু।
কলকাতার স্বাধীন বাংলা ম্যাগাজিনকে ’৯৯ সালে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন ছফা। সেখানে তিনি বলেন, বাংলা ভাগের জন্য আনন্দবাজার পত্রিকার ভূমিকা অনেক। বিখ্যাত ভারতীয় লেখক সমর সেনের বই ‘বাবু বৃত্তান্ত’কে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “আমরা যখন ভাষা আন্দোলন করছি, সমর সেনের ‘বাবু বৃত্তান্ত’ পড়ুন, তখন রায়ট লাগাবার জন্যে ইলিশের পেটে হিন্দু রমনীর মস্তক পাওয়া গেছে বলে সংবাদ লিখে আনন্দবাজার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে।”
তিনি আরও বলেন,
“বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার পর বাংলাদেশে তিন জন মানুষ মারা গেছেন। আর মমতা বন্দোপাধ্যায় ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছে, কোলকাতা শহরতলীতেই মারা গেছেন একশজন। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের একশ জনকে আমরা পঞ্চাশ ধরতে পারি। এই তিনজন মানুষের মৃত্যুকে নিয়ে পৃথিবীব্যাপী আনন্দবাজার যে কাণ্ডটা করল এটা কোন দরিদ্র প্রতিবেশীর প্রতি কোন ভদ্রোলোক করে না। মনে বিষ না থাকলে এটা সম্ভব নয়।”
”…পশ্চিম বাংলার আপনারা বাঙালির ভাষা সংস্কৃতি ও স্বাধীন অস্তিত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করছেন, তবে তার পিছনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অস্তিত্ব একটি প্রেরণা হিশেবে কাজ করছে। একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হিশেবে বাংলাদেশ তার নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াক, রাজনৈতিক স্বার্থেই দিল্লির শাসকরা এবং তাদের প্রধান এজেন্ট আনন্দবাজার তা চায় না।“
কলকাতার স্বাধীন বাংলা সাময়িকীতে প্রকাশিত আহমদ ছফার সাক্ষাৎকার, ১৯৯৯
ভারতের পানি অবরোধের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানির ফারাক্কা অভিযানের বিরুদ্ধে আনন্দবাজারের “কুৎসিত এডিটোরিয়াল” ছাপার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন ছফা।
এসব থেকে বোঝা যায় যে অতীতেও বাংলাদেশ-বিরোধী অপপ্রচার আনন্দবাজার ছেপেছে বস্তুনিষ্ঠতার ধার না ধেরেই। এছাড়া আনন্দবাজারের সহ-প্রকাশনা ‘দেশ পত্রিকা’য় নিরদ চৌধুরীর কুখ্যাত নিবন্ধের কথাও আমরা স্মরণ করতে পারি, যেখানে কিনা আমাদের দেশকে লেখা হয়েছিল ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’। এ নিয়ে প্রতিবাদের মুখে সরকার দেশ পত্রিকাই বন্ধ করে দেয়। [ওই পদক্ষেপে দেশ পত্রিকা আর্থিকভাবে এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে প্রকাশনাটিকে সাপ্তাহিক থেকে পাক্ষিক করে ফেলা হয়।]
শেষ কথা…
এই জমানায় তথ্যের অবাধ প্রবাহকে সবাই স্বাগত জানায়। তাই হয়তো অতীতের মতো সাংবাদিকতার নামে জঘন্য কাজকারবার কারও পক্ষেই করা সম্ভব নয়। তবে সাংবাদিকতার একেবারে মৌলিক নীতি-নৈতিকতা যখন এভাবে আনন্দবাজার লঙ্ঘণ করে, তার যথাযথ সমালোচনা হওয়া উচিৎ। এখন যখন ‘ফেক নিউজ’, ‘সত্য-উত্তর’ ও ‘অল্ট-ফ্যাক্টস’-এর মতো নয়া ধ্যানধারণা বৈশ্বিক সংবাদ মাধ্যম জগতে আলোড়ন তুলছে, তখন আনন্দবাজারের এই ‘অপসাংবাদিকতা’ চ্যালেঞ্জের উর্ধ্বে থাকতে পারে না।
[বাড়তি তথ্য: এই নিবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার বেশ কিছুদিন পর আমি ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় বিভাগে যোগদান করি। যোগদানের কয়েকদিন আগে আমাদের প্রথম সাক্ষাতে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম এই নিবন্ধের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। তিনি আমাকে জানান, এই নিবন্ধ ছাপা হওয়ার পর ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর সাথে আনন্দবাজারের একটি সম্ভাব্য কলাবরেশন ভেস্তে যায়। কারণ হিসেবে এই নিবন্ধের কথাও জানিয়ে দেওয়া হয় পরোক্ষভাবে।]